আফ্রিকায় গণহত্যার দায় স্বীকার করে জার্মানি ও ফ্রান্সের ক্ষমা প্রার্থনা
ইউরোপের সাবেক দু’ঔপনিবেশিক শক্তি-ফ্রান্স ও জার্মানি, গত দু’দিনে আফ্রিকায় তাদের অপরাধের দায় স্বীকার করেছে। শুক্রবার জার্মান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নেয় যে নামিবিয়ায় তাদের ঔপনিবেশিক শাসনের সময় সেখানে গণহত্যা চালানো হয়েছিল।
নামিবিয়ার জনগণ ও গণহত্যার শিকার মানুষদের উত্তরসূরিদের কাছে ক্ষমা চেয়েছে জার্মান সরকার। ওই অপরাধের ক্ষতিপূরণ দিতে রাজী হয়েছে জার্মান সরকার। এ ক্ষতিপূরণের চুক্তি স্বাক্ষরের পর জার্মানির প্রেসিডেন্ট নামিবিয়া গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে নামিবিয়ার জনগণের কাছে ক্ষমা চাইবেন।
ফ্রান্স, বৃহস্পতিবার, রোয়ান্ডায় ১৯৯৪ সালের যে ভয়াবহ জাতিগত দাঙ্গায় কমপক্ষে আট লাখ লোক মারা যায়, ওই গণহত্যার দায় স্বীকার করে। রোয়ান্ডার রাজধানী কিগালিতে গিয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ ওই দেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন।
নামিবিয়ার গণহত্যা ও জার্মানি ১৮৯৪ থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত নামিবিয়া জার্মান ঔপনিবেশিক শাসনে ছিল। তখন ওই দেশের নাম ছিল জার্মান দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকা। এ ঔপনিবেশিক শাসনের সময় যে গণহত্যা সেখানে চালানো হয়, তাকে অনেক ঐতিহাসিক বিংশ শতাব্দীর ‘বিস্মৃত গণহত্যা‘ বলে বর্ণনা করেছেন।
হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছিল ১৯০৪ সালে যখন হেরেরো ও নামা উপজাতি তাদের জমি ও গবাদিপশু দখলের বিরুদ্ধে জার্মান ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে।
ওই সময় নামিবিয়ায় জার্মানি সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন লোথার ফন ট্রোথা। তিনি ওই দু’উপজাতিকে নির্মূল করে দেয়ার নির্দেশ জারি করেন। তাদের বাড়ি-ঘর জায়গা থেকে উচ্ছেদ করে জোর করে দলে দলে মরু অঞ্চলে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
কেউ যখনই তাদের জায়গা জমি বা বাড়িতে ফিরতে চেয়েছে, তখনই তাদের ধরে হয় হত্যা করা হয়েছে, না হয় জেলখানায় ঢোকানো হয়েছে। এভাবে কত মানুষের প্রাণ গিয়েছিল তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই, তবে তা হাজার হাজার।
ওই সময় প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল আদিবাসী এ দু’জনগোষ্ঠী। বহুদিন ধরে নামিবিয়া ওই গণহত্যার অপরাধ স্বীকার করে নিয়ে ক্ষতিপূরণের জন্য জার্মানির ওপর চাপ দিচ্ছে।
পাঁচ বছর ধরে দু’সরকারের মধ্যে দেন-দরবারের পর শুক্রবার জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেইকো মাস এক বিবৃতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নেন যে নামিবিয়ায় গণহত্যা চালানো হয়েছিল।
নামিবিয়া ও গণহত্যার শিকার মানুষদের উত্তরসূরিদের কাছে জার্মান সরকারের হয়ে ক্ষমা চেয়েছেন তিনি। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘জার্মানি তাদের ঐতিহাসিক ও নৈতিক দায় স্বীকার করছে এবং নামিবিয়ার জনগণ আর অপরাধের শিকার মানুষদের উত্তরসূরিদের কাছে ক্ষমা চাইছে।’
১১০ কোটি ইউরো (১৩৪ কোটি ডলার) ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়েছে জার্মানি। এ টাকা নামিবিয়ার শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়নে খরচ করা হবে। অবশ্য আগামী ৩০ বছর ধরে এ টাকা দেয়া হবে।
নামিবিয়ার অনেক গোষ্ঠী নেতা এতে খুশি নন, তারা দু’সরকারের মধ্যে এ বোঝাপড়া অনুমোদন করেননি। হেরেরো আদিবাসী গোষ্ঠীর প্রধান ভেকুই রুকোরো, যিনি জার্মানির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি বলেন, ঔপনিবেশিক শাসকরা যে অপূরণীয় সর্বনাশ তাদের করেছে ওই তুলনায় এ ক্ষতিপূরণ যথেষ্ট নয়।
রয়টার্স সংবাদ সংস্থাকে তিনি বলেন, ‘নামিবিয়ার সরকার দেশের স্বার্থ বিক্রি করে দিয়েছে।’ হেরেরো ও নামা উপজাতির অনেকে আশা করছিলেন নামিবিয়া ও জার্মানির এ চুক্তির পর তাদের পূর্বপুরুষদের জমিজমার মালিকানা তারা ফিরে পাবেন। ক্ষতিপূরণ হিসাবে তাদের হাতে কিছু পয়সা আসবে। তবে জার্মানি প্রথম কোনো সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তি যারা তাদের অতীত অপরাধ ও তার ক্ষতিপূরণ নিয়ে আপস মীমাংসা করলো।
রোয়ান্ডার গণহত্যায় দায় স্বীকার ফ্রান্সের জার্মানি নামিবিয়ার তাদের ঐতিহাসিক অপরাধের দায় স্বীকার ও ক্ষমা প্রার্থনার আগের দিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার ফ্রান্স প্রায় হঠাৎ তাদের সাবেক উপনিবেশ রোয়ান্ডায় ১৯৯৪ সালের ভয়াবহ গণহত্যার দায় স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছে।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ রোয়ান্ডার রাজধানী কিগালিতে গিয়ে দায় স্বীকার করেন, দুঃখ প্রকাশ করেন এবং রোয়ান্ডার জনগণের কাছে ক্ষমা চান। কিগালিতে গণহত্যার স্মরণে নির্মিত যে সমাধিস্থলে গণহত্যার নিহত ২৫০,০০০ টুটসিকে কবর দেয়া হয়েছিল, সেখানে এক অনুষ্ঠানে ম্যাক্র বলেন, ‘আমাদের দায় স্বীকার করতে আমি এখানে হাজির হয়েছি, আমাদের ক্ষমা করে দিন।’
১৯৯৪ সালে রোয়ান্ডার যে গৃহযুদ্ধে কমপক্ষে আট থেকে ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, যাদের সিংহভাগই টুটসি জাতিগোষ্ঠীর, তাতে ফ্রান্সের ভূমিকা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে।
ওই সময় টুটসিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিয়োজিত মিলিশিয়া রোয়ান্ডান প্যাট্রিওটিক ফ্রন্ট্রের (আরপিএফ) সাথে জড়িতদের শায়েস্তা করার জন্য হুতু-নেতৃত্বের সরকারকে নানাভাবে সাহায্য করেছে ফ্রান্স।
শুধু সরকার নয়, ইন্তারহামওয়ে এবং ইম্পুযামুগাম্বি নামে সরকার সমর্থিত যে দুটো হুতু মিলিশিয়া গোষ্ঠীকে গণহত্যা চালানোর জন্য দায়ী করা হয় তাদেরকেও অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিতে সাহায্য করতো ফ্রান্স।
১৯৯৪ সালের এপ্রিলে গুলিতে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ওই সময়কার প্রেসিডেন্ট জুভেনাল হাবিয়ারিমানা মারা যাওয়ার পর শুরু হয় সাধারণ টুটসিদের টার্গেট করে গণহত্যা।
প্রায় ১০০ দিন ধরে চলা ওই হত্যাকাণ্ডে মানুষজনকে বাড়িতে, উপসনালয়ে ঢুকে হত্যা করা হয়েছে। স্কুলে ঢুকে শিশুদের হত্যা করা হয়েছে। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে প্রধান যে অভিযোগ তা হলো এমন একটি জাতিগত রক্তপাতের হুমকি তৈরি হয়েছে তা নিয়ে পরিষ্কার ইঙ্গিত থাকলেও তারা কিছুই করেনি।
গণহত্যার শেষ দিকে ‘সেফ জোন’ বা নিরাপদ জায়গা তৈরি করতে ফ্রান্স সৈন্য মোতায়েন করেছিল। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে ওই সেফ জোন দিয়ে প্রধানত হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া হুতু মিলিশিয়ারা প্রতিবেশী জায়ারে পালিয়ে গিয়েছিল।
১৯৯৪ সালের লড়াইতে জিতে আরপিএফ রোয়ান্ডায় ক্ষমতা নেয়ার পর ফ্রান্সের সাথে সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকে। রোয়ান্ডার সমস্ত ফরাসি প্রতিষ্ঠান-স্কুল, সাংস্কৃতিক সংগঠন – বন্ধ করে দেয়া হয়। স্কুলে ফরাসির বদলে ইংরেজিতে পাঠদান শুরু হয়। এমনকি, কখনো ব্রিটিশ উপনিবেশ না হয়েও রোয়ান্ডা কমনওয়েলথের সদস্যপদ নেয়।
গত ২৭ বছর ধরে রোয়ান্ডার গণহত্যায় ফ্রান্সের ভূমিকা নিয়ে কোনো ফরাসি সরকার তেমন উচ্চবাচ্য করেনি। একারণে প্রেসিডেন্ট পল কাগামে বৃহস্পতিবার বলেন, ‘দায় স্বীকার করে ম্যাক্র ‘সাহস দেখিয়েছেন। তবে গণহত্যা থেকে রক্ষা পাওয়া মানুষদের প্রধান সংগঠন ইবুকা বলেছে ম্যাক্র স্পষ্ট করে ক্ষমা চাননি।
বার্তা সংস্থা এপি বলছে ফরাসি নেতার সফরের সময় কিগালির রাস্তায় তাকে স্বাগত জানাতে কোনো মানুষকে দেখা যায়নি। কঙ্গোতে গণহত্যা ও বেলজিয়াম আফ্রিকায় গণহত্যা ও নৃশংসতার জন্য ইউরোপের যে ঔপনিবেশিক শক্তিটি সবচেয়ে বেশি নিন্দিত ওই বেলজিয়াম এখনো পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ প্রকাশ তো দূরে থাক অপরাধ স্বীকারও করেনি।
বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপল্ড ১৮৬৫ সালে মধ্য আফ্রিকায় বিশাল একটি এলাকা দখল করে ঔপনিবেশিক শাসন শুরুর পর হত্যা, নির্যাতনে এক কোটি মানুষের জীবন গিয়েছিল। এখনো পর্যন্ত বেলজিয়াম রাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে তার দায় স্বীকার বা ক্ষমা চায়নি।
২০২০ সালের জুন মাসে সাবেক উপনিবেশ গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের ৬০তম বার্ষিকীতে এক বিবৃতি বেলজিয়ামের রাজা ফিলিপে ঔপনিবেশিক শাসনামলে ঘটা অন্যায়ের জন্য তার ‘গভীর অনুশোচনা’ জানান।
কিন্তু এখনো পর্যন্ত বেলজিয়ামের কোনো সরকার তাদের বিতর্কিত অতীত নিয়ে কোনো কথা বলেনি। ১৮৮৫ সালে অন্য ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক দেশগুলোর মধ্যে যখন পুরো আফ্রিকা নিয়ে ভাগাভাগি চলছিল ওই সময় রাজা লিওপল্ডের প্রধান স্লোগান ছিল, ‘সভ্যতা।’ অর্থাৎ আফ্রিকায় সভ্যতার আলো নিয়ে যাবেন তিনি।
রাজা ফিলিপে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি আফ্রিকার সাধারণ মানুষের জীবনের মান উন্নয়নে সম্ভাব্য সবকিছু করবেন। তার কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বার্লিনে এক সম্মেলনে ইউরোপীয় নেতারা বেলজিয়ান রাজাকে আফ্রিকায় ২০ লাখ বর্গ কিলোমিটারের একটি জায়গা অনুমোদন করেন যেখানে তিনি ব্যক্তিগত উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করেন।
রাজা তার উপনিবেশের নাম দেন কঙ্গো ফ্রি স্টেট। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই নির্যাতন আর নৃশংসতার পরিচয় দিতে শুরু করেন রাজা লিওপল্ড। জোরপূর্বক শ্রম ব্যবহার করে রাবার চাষ, হাতির দাঁত ও নানা খনিজ দ্রব্যের ব্যবসা শুরু করে দেন বেলজিয়ান রাজা।
কোনো ধরনের অবাধ্যতা দেখলেই অত্যাচার, এমনকি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে ফেলার বহু প্রমাণ রয়েছে। ধরে ধরে মানুষকে দাস বানিয়ে ফেলা ছিল নৈমিত্তিক ঘটনা। শিশুদের জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে শিশু কলোনিতে অবদ্ধ করে রেখে সেনা প্রশিক্ষণ দেয়া হতো।
এসব কলোনিতে ৫০ শতাংশ শিশুই শেষ পর্যন্ত মারা যেত। এ ধরনের নির্যাতন, দুর্ভিক্ষ, রোগে-শোকে এক কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল বলে বলা হয়, যদিও অনেক ঐতিহাসিক এ সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক করেন।
খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকরা ও ব্রিটিশ একজন সাংবাদিক এডমন্ড ডেন মোরেল প্রথম কঙ্গোতে রাজা লিওপল্ডের ঔপনিবেশিক প্রশাসনের ভয়াবহ নির্যাতনের নানা চিত্র ফাঁস করে দেন। এতটাই দুর্নাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে যে ১৯০৮ সাল নাগাদ তৎকালীন ইউরোপীয় অন্য ঔপনিবেশিক প্রভুরাও নাখোশ হয়ে পড়েন।
তারপর বেলজিয়ামের সংসদ কঙ্গোতে তার ক্ষমতা কেড়ে নেয়। কিন্তু নিজের দেশ বেলজিয়ামে তার কাঁটাছেড়া কখনই তেমন হয়নি। বেলজিয়ামে রাজা লিওপল্ডের ১৩টি মূর্তি রয়েছে। এছাড়া অনেক রাস্তা, স্থাপনা ও পার্ক তার নামে।
গত বছর জাতিসংঘের একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ কঙ্গোতে ঔপনিবেশিক হত্যা-নির্যাতনের জন্য বেলজিয়াম রাষ্ট্রকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানায়। কিন্তু ব্রাসেলস এখনো চুপ। সূত্র : বিবিসি